বাংলাদেশের চিংড়ি শিল্প দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত। চিংড়ি আহরণ এবং এর পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে গুণগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সঠিক আহরণ এবং পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে চিংড়ির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।
আহরণের পূর্বে করণীয় কাজসমূহ
আহরণের আগে চিংড়ি প্রস্তুতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিশ্চিত করতে হবে:
১. দক্ষ এবং অভিজ্ঞ লোকবল সংগ্রহ করা।
২. বাজারমূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা।
৩. প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি যেমন প্লাস্টিক ঝুড়ি, ঝাঁকি জাল, বরফ, দাঁড়িপাল্লা ইত্যাদি সংগ্রহ করা।
৪. চিংড়ির আকার নিশ্চিত করে আহরণের পরিকল্পনা তৈরি করা।
আহরণের সময় করণীয় বিষয়সমূহ
আহরণের সময় চিংড়ি যাতে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য নিচের বিষয়গুলো অনুসরণ করা জরুরি:
১. এমন মেস সাইজের জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে ছোট আকারের চিংড়ি সহজেই বের হয়ে যেতে পারে।
২. ছোট আকারের চিংড়ি (জুভেনাইল) ধরা পড়লে দ্রুত তা ঘেরে ফিরিয়ে দেওয়া।
৩. নরম খোলসযুক্ত চিংড়ি রোধ করতে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার সাথে মিল রেখে আহরণ করা।
৪. ভোরে বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় আহরণ করা।
৫. চিংড়িকে আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো কোনো সরঞ্জাম বা পদ্ধতি ব্যবহার না করা।
৬. আহরণের পর চিংড়ি পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বরফ-ঠান্ডা পানিতে সংরক্ষণ করা।
৭. মৃত চিংড়িকে বরফসহ ১:১ অনুপাতে সংরক্ষণ করা।
আহরণের পদ্ধতিসমূহ
চিংড়ি আহরণে নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়:
১. আটল পদ্ধতি:
আটল বাঁশ দিয়ে তৈরি ফাঁদ যা সহজে এবং কম খরচে চিংড়ি আহরণে ব্যবহৃত হয়। এটি ঘেরের গভীর স্থানে বা পানি প্রবেশ ও নির্গমনের স্থানে স্থাপন করা হয়।
২. ঝাঁকি জাল পদ্ধতি:
যখন আটল বা ফাঁদে কম চিংড়ি ধরা পড়ে তখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে এটি শ্রমবহুল এবং সময়সাপেক্ষ।
৩. বেড় জাল পদ্ধতি:
বড় আকারের ঘের থেকে বেশি পরিমাণ চিংড়ি আহরণের জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর। একদিনে দুইবারের বেশি এই পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪. পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি:
ঘেরের পানি নিষ্কাশন করে অবশিষ্ট চিংড়ি আহরণ করা হয়। ভোরে ঠান্ডা অবস্থায় এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে কার্যকর।
আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির গুণগতমানের বিষয়ে যেসমস্ত অভিযোগ উত্থাপিত হয় তার অনেকটাই চিংড়ির ঘেরে এবং আহরণ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অসাবধানতা বা অজ্ঞতার কারণে ঘটে থাকে। আহরণের সময় থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার অভাবেই চিংড়ির গুণগত মানের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। সুতরাং, ঘের/খামার এবং প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ঠ ধাপগুলোতে চিংড়িকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা খুবই জরুরী
আহরণ পরবর্তী করণীয় কাজ এবং সতর্কতা
আহরণের পর চিংড়ির গুণগত মান বজায় রাখতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা প্রয়োজন:
১. চিংড়িকে পরিষ্কার এবং শীতল পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা।
২. ছাউনির নিচে বন্যপ্রানী বা কুকুর/বিড়াল থেকে দূরে রেখে পরিষ্কার মেঝেতে বা প্লাস্টিক শিটে চিংড়ি সংরক্ষণ করা।
৩. বরফ ও পানির অনুপাত ১:১ রেখে চিলিং (০-২.২ ডিগ্রী সে.) পদ্ধতিতে চিংড়ি ৫ মিনিট শীতল করলে চিংড়ি মরে শক্ত হয়ে যায় এবং এই অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. জীবাণুমুক্ত পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে চিংড়ি রাখা।
৫. চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৬. দূরবর্তী স্থানে পরিবহনের ক্ষেত্রে বরফের অনুপাত ১:২ রাখা।
৭. শীতল বাক্স বা রেফ্রিজারেটেড ভ্যানে পরিবহন নিশ্চিত করা।
চিংড়ি শিল্পে মান বজায় রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বাড়ানোর জন্য চিংড়ি আহরণ এবং পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের চিংড়ি শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হবে।