অ্যাকুয়াকালচারে নানাবিধ কারনে সৃষ্ট স্ট্রেস বা চাপ চাষকৃত চিংড়ির স্বাস্থ্য ও সার্বিক অবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে চিংড়ির গ্রোথ হ্রাস, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মারত্মক দুর্বল করে, এমনকি অপেক্ষকৃত কম শক্তিশালী ভাইরাসের বিস্তার ঘটিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে মড়কের সৃষ্টি করতে পারে। পক্ষান্তরে বলা যায়, এতে আমাদের চিংড়ি চাষীদের লগ্নিকৃত অর্থ ও সময় দুই’ই যেমন ধ্বংস করতে পারে এবং তেমনি দেশীয় মোট উৎপাদনে ঘাটতি ও বৈদেশিক রপ্তানিতে ঘটাতে পারে বিপর্যয়।
আমরা আজকে অ্যাকুয়াকালচারে চিংড়ির স্ট্রেসের যেসব মূল কারন যা সাধরনত সচারাচার ঘটে থাকে, সেগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাবে বা কী পয়েন্টগুলোর চম্বুক অংশ নিয়ে আলোচনা করব। চলুন তবে যাওয়া যাক সেই পর্বে,
পানির গুণমান: চিংড়ি চাষে পানির গুনমান সব থেকে গুরুত্বপূর্ন বিষয় গুলোর একটি। পুকুর বা ঘেরের পানিতে থাকা উচ্চ অ্যামোনিয়া বা নাইট্রাইটের মাত্রা, কম দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ-এর ওঠানামা, তাপমাত্রার অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা বা প্রয়োজনীয় সীমার বাইরে গরম হওয়া এবং অত্যধিক লবণাক্ততা ইত্যাদি পানির নিম্নমানের গুণের পরিচায়ক।
এগুলোর কারনে চিংড়ির উপর প্রচুর স্ট্রেসের তৈরী হয় যা কিনা খামারীর সফলতার অন্তরায় তৈরীর প্রধান কারন। পানির সঠিক গুনমান নিশ্চিত করা একজন চাষীর যেমন চাষের সফলতার জন্যে প্রয়োজন, তেমনি মানবিক ভাবে চিন্তা করলে চিংড়ি একটি প্রানী হিসাবে এটির নায্য অধিকার। আমরা যেমন গরু বা ছাগল অমানবিক পরিবেশে রেখে লালন-পালন করতে পারি নাহ, ঠিক তেমনি চিংড়ির জন্যে তার বেচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ অর্থ্যাৎ পানির গুনমান বজায় রেখে চাষ করা একটি অতিঅব্যশকীয় কাজ।
হ্যান্ডলিং এবং পরিবহন: চাষের জন্যে নেওয়া চিংড়ির জীবনযাত্রা শুরু হয় মুলত হ্যাচারীর চৌবাচ্চা অথবা নদীর পোনা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে। হ্যাচারীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন দিয়ে প্যাকিং করে পাঠানোর সময় অদক্ষ লোক দিয়ে কাজ করালে দেখা যায় সঠিক পরিমান অক্সিজেন দেওয়া হয় না অথবা অক্সিজেনের মান ভাল নয়, এমন ক্ষেত্রে চিংড়ির পোনা বা পিএল (পোষ্ট লার্ভা) এর হ্যান্ডলিং নিশ্চিত ভাবে বলা যায় নিম্নমানের হয়। এতে করে চিংড়ির পোনা তীব্র স্ট্রেসের সম্মুখীন হয়। এছাড়া প্যাকেজিং সঠিকভাবে হলেও পরিবহন ব্যবস্থা যদি সুষ্ঠ না হয় সেক্ষেত্রেও পিএল স্ট্রেসে পড়ে।
কাজেই বলা যায় এক ব্যাগে বেশি পোনার মুজুদ, রুক্ষ হ্যান্ডলিং, দীর্ঘ সময় বদ্ধ অবস্থায় থাকলে এবং পরিবহনের সময় বাতাসের সংস্পর্শে থাকার কারণে মারাত্নক স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে এবং পোনাকে অতি দুর্বল করে দেয় পুকুর বা ঘেরের পানিতে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্যে, যা কিনা পোনার বেঁচে থাকার শতকরা হার কমিয়ে দেয়।
অত্যধিক মজুদ: সনাতন অথবা উন্নত পদ্ধতি, উভয় ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের ঘের বা পুকুরের আয়তন অনুযায়ী পোনার ঘনত্ব নির্ধারন করতে হয়। উচ্চ ঘনত্বে মজুদ করলে এবং সঠিক ব্যবস্থপনা না থাকলে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা, অক্সিজেন স্বল্পতা, বর্জ্য উত্পাদন বাড়ে মানে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পায়, যা চিংড়ির জন্যে বিশাল স্ট্রেসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে পোনা মৃত্যুর হার বাড়ায়।
ফিডের গুণমান এবং পুষ্টি: ভারসাম্যহীন বা অপর্যাপ্ত পুষ্টি, অনুপযুক্ত ফিডের আকার এবং খারাপ ফিডের গুণমান চিংড়ির স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে স্ট্রেস তৈরী হয় এবং এর বৃদ্ধির হার হ্রাস পায়।
রোগ এবং প্যাথোজেন: ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী বা ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব সকল চিংড়ির মধ্যে স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে। এই স্ট্রেস ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে এবং সংক্রমণের জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
পরিবেশগত কারণসমূহ: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ঝড়, বন্যা, তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার অবস্থার আকস্মিক পরিবর্তন, চিংড়ির ঘের বা পুকুর তথা আবাসস্থানের পরিবর্তন করে এবং স্বাভাবিক অবস্থার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তীব্র স্ট্রেস তৈরী করতে পারে।
সামাজিক স্ট্রেসঃ খাদ্যের জন্যে আক্রমনাত্মক আচরণ, আধিপত্যের শ্রেণিবিন্যাস, একই ঘের বা পুকুরে চাষের ক্ষেত্রে একই বা ভিন্ন প্রজাতি ও আকারের পার্থক্যের কারনে চাষকৃত জলজ প্রানীর মধ্যে নানা স্তরে স্ট্রেস সৃষ্টি হতে পারে।
শব্দ এবং আলো: অত্যধিক শব্দ বা আলোর আকস্মিক পরিবর্তন চিংড়ির উপর স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে, এতে তাদের সার্বিক আচরণ, শারীরিক বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে।
শ্রীম্প অ্যাকুয়াকালচারে কমবেশি এইসব চাপ বা স্ট্রেসের কারণগুলি প্রশমিত করার প্রচেষ্টার মধ্যেই মূলত সঠিক চিংড়ি চাষের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিদ্যমান। এই সকল বিষয় সর্তক নজরদারি চিংড়ির স্ট্রেস কমিয়ে চাষে সফলতা লাভের সম্ভবনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তলে।