সুন্দরবন, বিশ্বের সব থেকে বড় একক ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট, শুধু যে বৃহৎ তা নয়, এটিকে ধরা হয় পৃথিবীর অন্যতম রহস্যঘেরা এক মায়াবী বন। আমরা এনভায়রনমেন্টাল ফ্রেন্ডলি, মর্ডান ও সাসটেইনাবল অ্যাকুয়াকালচারের চর্চা করি এবং প্রসারের জন্যে সর্বদাই সচেষ্ঠ। আর আমাদের চিংড়ি চাষীদের বিশাল একটা অংশ উপকূলীয় সুন্দরবন ও সংলিষ্ট এলাকায় তাদের চাষ কার্যক্রম চালায়। তাই, পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনের সংরক্ষন, পুনঃবনায়ন আমাদের কার্যক্রমের অন্যতম স্তম্ভ।
স্বভাবতই, কাজের প্রয়োজনে সুন্দরবন নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি করা হয়, আর তারই অংশ হিসাবে নানা জন্যের বিভিন্ন লেখা পড়া হয়, এর মধ্যে কলকাতার “মলয় পাড়ে” এর লেখা পড়ে দারুন লাগল আর তার থেকে আজ ঈষৎ পরিমার্জন করে আজকে আমি গল্প করব এই সুন্দরবন বা বাদাবনের ইতিকথা নিয়ে। চলুন তবে শুরু করা যাক।
এখন থেকে সাড়ে তিনশ’ বছরেরও বেশি আগে ‘টেরশেলিং’ নামে একটি ওলন্দাজ জাহাজ যাচ্ছিল বাটাভিয়া (এখনকার জাকার্তা) থেকে পশ্চিমবঙ্গের হিজলী। চট্টগ্রাম পেরোনোর পর জাহাজের নাবিকরা বাকি পথটা সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তাদের জাহাজটি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হলে নাবিকরা সুন্দরবনে নেমে পড়তে বাধ্য হন। ভয়াল সুন্দরবনের ভেতর বিদেশি নাবিকরা কতটা বিপদে পড়েছিলেন তা অনুমান করা চলে। বহু ক্লেশ স্বীকার করে দেশে ফেরার পর এক নাবিক সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন আমস্টার্ডামের এক পত্রিকায়।
এই ঘটনার আরো আগে, ১৫৯৯ সালে দুই রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান যাজক বাখরগঞ্জে রাজা রামচন্দ্র রায়ের রাজধানী বাকলা থেকে রাজা প্রতাপ আদিত্যের রাজধানী ধুমঘাট (বর্তমান সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে) গিয়েছিলেন সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই। এই দুই খ্রিস্টান যাজক ও সেই ওলন্দাজ নাবিকদের বিবরণ থেকে সেই সময়কার সুন্দরবন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয় যায়। তারা যে বিবরণ দিয়েছিলেন, তা মোটামুটি এরকম, ‘এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে হাতির মত প্রকাণ্ড গণ্ডার, মোষের মত প্রকাণ্ড বাঘ, বাঘের মত প্রকাণ্ড শূকর, গরুর মত প্রকাণ্ড হরিণ এবং নৌকার মত প্রকাণ্ড কুমির বিচরণ করে।’ তারা আরো লিখেছিলেন, ‘এই বনে সবই বিচিত্র। এখানে মাছে গাছ বেয়ে ওঠে, কুমির ডাঙ্গায় এসে জীবজন্তু ধরে, বাঘ কখনো বা গাছের ডালে বিশ্রাম করে; কখনো সাঁতার দিয়ে সাগরের মত ভীষণ নদী পার হয়ে যায়। এখানে এক নদীর দুই দিকে দুই স্রোত বয়। কোথাও কোথাও সেই স্রোত ভীষণ রূপ ধারণ করে।’
বিপদাপন্ন বিদেশি নাবিক এবং ভয়ার্ত যাজকদের এই বিবরণে অতিরঞ্জন অবশ্যই ছিল; তবে আজ থেকে একশ বছর পর হয়ত কোমলমতি শিশুরা তাদের স্কুলপাঠ্যে খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরার দক্ষিণভাগ সম্পর্কে পড়বে—’একদা এখানে সুন্দরবন নামে এক বিশাল বন ছিল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঘ বাস করত সেখানে।’
সুন্দরবনের গণ্ডার বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগে। বন্য মোষের অস্তিত্বও এখন আর নেই। বিশ্বসেরা বাঘ—বেঙ্গল টাইগার ঠাঁই পেয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায়। শুশুক, কুমির কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। অজগর, হাঙ্গর, বন মোরগ, বহু রকমের পাখি ও মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। উজাড় হচ্ছে বন। আগের মত বড় বড় গাছপালা এখন আর সুন্দরবনে দেখা যায় না। সাগরের উচ্চতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে লবণাক্ততাও। ফারাক্কা বাঁধতো আছেই, এর ওপর আছে লবণ পানি ধরে রেখে সুন্দরবন এলাকায় যথেচ্ছ চিংড়ি চাষ। মংলা বন্দরে চলাচলকারী নৌযানের পোড়া তেল-মবিলের কালো কালো দাগ সুন্দরবনের গাছপালার গোড়ার দিকে তাকালেই নজরে পড়ে।
সুন্দরবনের ভেতর জাহাজসহ নানা রকমের নৌযান চলাচলের শব্দ, রাতের বেলা সেগুলোর আলো এবং সার্চ লাইট বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশে বড় রকমের বিঘ্ন ঘটায়। সিমেন্ট কারাখানাসহ একের পর এক বহু কারখানা গড়ে উঠছে মংলায়, যেগুলো পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে নীরবে। মোট কথা, গোটা পরিবেশই সুন্দরবনের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে প্রতিদিন। এ গেল বন্দরের স্বাভাবিক অবস্থার কথা। দুর্ঘটনার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। বনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী ক্ষতিকর রাসায়নিকবাহী জাহাজ বা বন্দরের আশপাশের কলকারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে তা বনের জন্য কতটা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে—সে হিসাব কারো জানা নেই।
কবে থেকে শুরু
সুন্দরবন সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন যে বইতে উল্লেখ আছে, সেটা রামায়ন। রামায়নে এই বনকে বলা হয়েছে ‘রসাতল’। নানা রকম হিংস্র বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল অতীব ভয়ংকর এই জঙ্গলকে রসাতল হিসাবে উল্লেখ করা বিচিত্র নয়। অথবা এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে। রামচন্দ্রের প্রপিতামহ দিগ্বিজয়ী রঘু বঙ্গদেশে আর্যদের আধিপত্য বিস্তারে বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নৌযুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী এদেশের মানুষকে পরাস্ত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বহু চেষ্টার পর সুন্দরবনের একটি ছোট দ্বীপ দখল করেছিলেন মাত্র এবং সেখানেই একটি স্তম্ভ নির্মাণ করে তিনি তার ‘বিজয়’ ঘোষণা করেছিলেন। একারণেও এই অঞ্চল তাদের কাছে ‘রসাতল’ ছিল কিনা কে জানে!
রামায়নের পর মহাভারতই দ্বিতীয় গ্রন্থ যাতে সুন্দরবনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, অর্জুন সুন্দরবনের গঙ্গাসাগর সঙ্গমে তীর্থ স্নানে গিয়েছিলেন। ‘পদ্মপুরানে’ সুলোচনা নামে এক রাজকুমারী পুরুষ বেশে এই বনে একটা প্রকাণ্ড গণ্ডার বধ করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। ২০০ বা ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চাঁদ সওদাগর এই এলাকায় একটি নগরী গড়ে তোলেন। বাগমারা ফরেস্ট ব্লকে তার ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মিলেছে। তবে এ প্রাচীন গ্রন্থাদিতে সুন্দরবন বা এর পশু-পাখি, গাছ-পালা সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।
সুন্দরবনে প্রথম জরিপটি হয় মহামতি আকবরের সময়, টোডরমলের নেতৃত্বে। তবে মনে রাখা দরকার, সুন্দরবনের মত এত বিশাল, গভীর এবং নদ-নদী আকীর্ণ জঙ্গলের পূর্ণাঙ্গ জরিপ সে আমলে প্রায় অসম্ভবই ছিল। অবশ্য সম্রাট আকবর নিজে এই বন দেখতে এসেছিলেন এবং এর রূপ তাকে মুগ্ধ করেছিল। নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর নবাবের আসনে আসীন হয়ে মীরজাফর বাংলার যে বিস্তীর্ণ এলাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে উপঢৌকন হিসাবে দিয়েছিলেন, তার ভেতর সুন্দরবনেরও একটা বড় অংশ ছিল। সুন্দরবনের অফুরন্ত সম্পদ কোম্পানির বড় কর্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ১৮১১ সালে শুরু হয় এই বনের জরিপ। কোম্পানির আমলেই সুন্দরবনের জমি কৃষকদের মধ্যে বিলিবন্টন করে জঙ্গল সাফ করার ব্যবস্থা করা হয়। মূলত তখন থেকেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব সংকটের শুরু।
সুন্দরনের ধ্বংস শুরু কবে থেকে—এই প্রশ্নটা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগের’ মত। কারণ সুন্দরবনের ভেতর অনেক স্থানে গুপ্ত যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) মুদ্রা, অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ, দেবমূর্তি, প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ, পুকুরের বাঁধা ঘাট, মাটির ভাঙ্গা বাসনকোসন, ইটের স্তুপ যেমন পাওয়া গেছে তেমনি বিক্রমপুর, গোপালগঞ্জ, যশোর, কলকাতা প্রভৃতি স্থানে মাটি খুঁড়ে সুন্দরী গাছের গুঁড়িও পাওয়া গেছে। সুন্দরী গাছ একান্তভাবেই সুন্দরবনের। গোপালগঞ্জে কাওড়াকান্দি ও ওড়াকান্দি নামে যে দুটি স্থান আছে তা সুন্দরবনের পরিচয় বহন করে। ক্যাওড়া ও ওড়া সুন্দরবনের দুটি প্রধান বৃক্ষ। বাগেরহাটে খানজাহান আলী দীঘি খননের সময় এখানে মাটির নিচে একটি বৌদ্ধ অথবা শিব মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এমন হতে পারে যে, আদিকাল থেকে সুন্দরবন থাকলেও মাঝে মাঝে সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে তবে নানা কারণে তা পরিত্যক্ত হয়ে আবার বনভূমিতে পরিণত হয়। রেনলের ম্যাপে (১৭৬১) তত্কালে জনবিরল দক্ষিণবঙ্গকে ‘মগদিগের দ্বারা উত্সন্ন’ লেখা হয়েছে। এই সময় গোটা বাখরগঞ্জ এলাকা জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছিল। প্যারিসে রক্ষিত মোগল আমলের মাঝামাঝি পর্তুগিজদের প্রণীত একখানি ম্যাপে সুন্দরবন এলাকায় পাঁচটি সমৃদ্ধ বন্দরের উল্লেখ দেখা যায়। তবে পরবর্তীকালে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে এসব বন্দর ও জনপদ পরিত্যক্ত হয় বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকরা। এর ওপর ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বার বার আঘাত হেনেছে সুন্দরবনে।
মগের মুল্লুক
সুন্দরবনের কথা বলতে গেলে এই অঞ্চলে মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা এক সময় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সে কথার উল্লেখ না করলে বিষয়টি অপূর্ণ থেকে যাবে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়েরের ভ্রমণ বৃত্তান্তে তাদের অকথ্য অত্যাচারের কিছু কিছু উল্লেখ আছে, যা পড়লে আজো শিউরে উঠতে হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলার শাসন ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে। সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যু আর মগদের অত্যাচারে গোটা দক্ষিণবঙ্গে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আজ সেকথা কল্পনা করা দুরূহ। বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা তাদের হামলার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উপকূলীয় এলাকা শুধু নয়, ছোট ছোট নৌযান নিয়ে তারা দেশের অনেক ভেতরেও ঢুকে পড়ত। উপকূলভাগ থেকে সুদূর ঢাকা পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। নদী তীরবর্তী কোন বাড়িতে রাতের বেলা আলো জ্বালানো হত না জলদস্যুদের ভয়ে। নদীপথে বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বার্নিয়ের লিখেছেন, ‘ফিরিঙ্গি আর মগদের অত্যাচারে ধু ধু করছে গ্রামের পর গ্রাম। এককালে যেখানে লোকালয় ছিল, এখন সেখানে বাঘসহ বন্য জন্তু চরে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছন্দে।’
মানরিকের বর্ণনায় দেখা যায়, ১৬২১ সাল থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪২ হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এই জলদস্যুরা। ১৬২৯ সালের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ হাজার মানুষকে। এই হিসাব প্রকৃত হিসাবের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। কারণ, সে আমলে, সেই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ হতভাগ্য বাঙ্গালির হিসাব রাখা সম্ভব ছিল না। দস্যুরা গ্রামকে গ্রাম লুটপাট করত। লুটপাট শেষে যা নিয়ে যেতে পারত না তাতে আগুন ধরিয়ে দিত। পুড়িয়ে দিত গ্রামের পর গ্রাম। বড় বড় হাট-বাজার এমনকি বিয়ে বাড়িতে বা উত্সবের সময়ও তারা চারদিক থেকে হামলা চালিয়ে লোকজন ধরে নিয়ে যেত, লুটপাট করত। তাদের হাত থেকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ বা শিশু-কারো নিস্তার ছিল না। তবে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল নারী।
ধরে নেয়া লোকজনের হাতের তালু ছিদ্র করে তার ভেতর সরু বেত ঢুকিয়ে দিয়ে বেঁধে জন্তুর মত গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হত জাহাজের পাটাতনের নিচে। অন্য দেশের বন্দরে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হত তাদের। বাঙ্গালি বিক্রির একাধিক বাজারও ছিল আরাকানে। মগ এবং পর্তুগিজরা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মগরা চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। আর পর্তুগিজরা দখল করেছিল সন্দ্বীপ। সে আমলে সন্দ্বীপে বিপুল পরিমাণ লবণ উত্পন্ন হত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও যেত সেই লবণ। একারণে পর্তুগিজদের কাছে সন্দ্বীপ ছিল অত্যন্ত লোভনীয় স্থান।
সেই সময় যেসব বাঙালি নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত, তাদের সেই দুঃখের কাহিনী দীর্ঘশ্বাসের মত আজো লুকিয়ে আছে কিছু কিছু লোকগানে। স্থানীয় ভাষায় রচিত এসব লোকগীতির একটি মোটামুটি এরকম ঃ এক গৃহবধূকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সে তার স্বামীকে উদ্দেশ করে গাইছে, “অভাগিনীকে মনে রেখো। ঘাটে আমার কলসী পড়ে রইল, আমার হাতের কঙ্কনও ফেলে এসেছি। আমাকে মনে হলে যদি তোমার খারাপ লাগে তবে সেই কলসী আর কঙ্কনে তোমার হাত দুখানি বুলিয়ে দিও। তাতে আমার বুক জুড়াবে। আর তুমি সুন্দরি দেখে কোন একজনকে বিয়ে করো। আমি তোমার যে ভালোবাসা পেতে কাঙ্গাল ছিলাম, সেই ভালোবাসা তাকে দিও। অভাগিনীর কপালে তা নেই!”
সুন্দরবনে গুপ্তধন
সুবাদার শায়েস্তা খান বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন ১৬৬৩ সালে। এই ঘটনাই মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের কপালে মরণ ডেকে আনে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মাথায় মগ ও পর্তুগিজদের এমন তাড়া করেন যে, তারা গোটা সুন্দরবন এলাকা, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম থেকে পড়িমরি করে পালাতে লাগল। লোককাহিনীতে এই ঘটনা ‘মগ ধাওয়ানি’ নামে পরিচিতি পায়। মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা পালানোর সময় তাদের সংগৃহীত ধনরত্ন সঙ্গে নিয়ে যাওয়ারও ফুরসত পেল না। ফলে তারা সুন্দরবনের নানা স্থানে সেগুলো পুঁতে রেখে সেসবের সাংকেতিক ম্যাপ তৈরি করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তারা সুযোগ বুঝে সেই সব ম্যাপ সঙ্গে নিয়ে গুপ্তধন খুঁজতে আসত। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় এর এক সরস বর্ণনা আছে।
মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের রেখে যাওয়া এসব গুপ্তধনের অনেকগুলো এখনো অক্ষত থাকতে পারে বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতর প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষেও অনেক গুপ্তধন বিভিন্ন সময় পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।
খানজাহান আলি পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাগেরহাটের শাসনভার নিয়ে এদেশে আসেন। তিনি মূলত ছিলেন সুফি দরবেশ। সুন্দরবন এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচার ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। বিভিন্ন স্থানে তিনি দীঘি খনন করে স্থানীয়দের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতেন এবং দরগাহ শরিফ নির্মাণ করতেন। বাগেরহাট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটা সড়কও নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। এসব কাজের জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হত। কিন্তু সে আমলে টাকা পয়সা নিরাপদে সুরক্ষিত রাখার কোন সুবিধা না থাকায় তিনি তার বাসস্থানের আশেপাশে মাটি খুঁড়ে সেখানে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা রেখে দিতেন। পরবর্তী সময়ে বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে তার রেখে যাওয়া বিপুল মুদ্রা উদ্ধার হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক ম্যানগ্রোভ বন—সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় বিশাল এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। দুইশত বছর আগে এই বনের আয়তন ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৭শ’ বর্গ কিলোমিটার। এখন কমতে কমতে তা এক তৃতীয়াংশে ঠেকেছে। বনের দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই বনভূমির আয়তন প্রায় ৪ হাজার ১১০ বর্গ কিলোমিটার।
সুন্দরবন জুড়েই জালের মত বিছিয়ে আছে চার শতাধিক নদ-নদী-খাল। অনেক নদী যেমন বিশাল তেমন স্রোতস্বিনী। তবে দিনে দিনে এসব নদ-নদীর বিস্তৃতি যেমন কমছে, তেমনি কমছে সে্রাতের তোড়। অতীতে পদ্মার বিভিন্ন শাখা নদী থেকে মিষ্টি পানি সুন্দরবনের এসব নদীবাহিত হয়ে বছরের ছয় মাস সাগরে গিয়ে পড়ত। এর ফলে বনের লবণাক্ততা একটা পর্যায়ে সীমিত থাকত। মিষ্টি পানির সঙ্গে এসব নদী বিপুল পরিমাণ পলিমাটিও সাগরে নিয়ে যেত। পলি জমার ফলে হাজার হাজার বছর ধরে সুন্দরবনের দক্ষিণভাগ ক্রমশঃ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিষ্টি পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সাগরে পলিও আর তেমন জমে না। এখন যে সামান্য পলিমাটি আসে, নদীতে স্রোত না থাকায় তার বেশিরভাগই সাগরে পৌঁছাতে পারে না, নদ-নদীর বুকেই জমে। ফারাক্কা বাঁধ এবং উপকূলীয় এলাকায় লবণ-পানি ধরে রেখে ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। লবণাক্ততা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু গাছপালা ও প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, স্থানে স্থানে সুন্দরি গাছে ব্যাপকভাবে ‘আগামরা’ রোগ দেখা দিয়েছে। বন দফতরেরই এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৫৯ সালে এই বনে যেখানে প্রতি হেক্টরে গাছের গড় সংখ্যা ছিল ২৯৬টি, ১৯৯৬ সালে এই সংখ্যা নেমে এসে দাঁড়ায় ১৪৪টিতে। জঙ্গলের লাগোয়া এমন অনেক গ্রাম বা জনবসতি আছে যেগুলো পুরোটাই বনের জমি জবরদখল করে গড়ে উঠেছে। গড়ে তোলা হচ্ছে ভূমিহীনদের জন্য নতুন নতুন গুচ্ছগ্রাম।
পশু পাখি গাছপালা
বনের নাম সুন্দরবন। দেখতে সুন্দর তো বটেই তবে এই বনে সবচেয়ে বেশি যে গাছ জন্মে তার নাম সুন্দরি। ধারণা করা হয়, এই সুন্দরি গাছ থেকেই সুন্দরবন নামটা এসেছে। ম্যানগ্রোভ হল বিশেষ ধরনের বন, যেগুলো উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জলাভূমিতেই সাধারণত গড়ে ওঠে। এখানকার গাছপালা এমনই যে, লবণাক্ত পানিতে গোড়ার দিকটা তলিয়ে গেলেও গাছপালার কোন ক্ষতি হয় না। এখানকার নদী খালে প্রতিদিন দুই বার জোয়ার ও দুই বার ভাটা হয়। জোয়ারের সময় নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যায় আর ভাটার সময় নদী খালের পানি অনেকটা নিচে নেমে যায়। জোয়ারের পানিতে বেশিরভাগ গাছপালার গোড়ার দিকটা তলিয়ে যায় এবং প্রায়ই সাগরের প্রবল ঝড় ও ঢেউ এসব গাছের ওপর আছড়ে পড়ে। সে কারণে এসব গাছের শিকড় অত্যন্ত মজবুত হয় এবং শ্বাস গ্রহণের জন্য শিকড় থেকে উঁচু উঁচু এক রকমের শ্বাসমূল বের হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের উপকূলভাগ রক্ষার স্বার্থে এ ধরনের বন রক্ষা বা সৃজনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে থাকে। বিশ্বের ১১৮টি দেশে এরকম বন আছে।
১৯০৩ সালে ডেভিড প্রেইন তার ‘বেঙ্গল প্ল্যান্টস’ বইতে সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ১৭ রকমের ফার্ন, ১৯ রকমের হোগলা, ১৮ ধরনের সিজ, শিম জাতীয় উদ্ভিদ ৩৫ ধরনের, ৫০ রকমের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে। সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি জন্মে সুন্দরি গাছ। সুন্দরি গাছ ছাড়া পশুর নামে আরেক রকমের গাছ এই বনে জন্মে, যার কাঠও বেশ দামি। ঘরের আসবাব তৈরিতে এই কাঠ ব্যবহার হয়।
এছাড়া এই বনের অন্যান্য গাছ-পালার মধ্যে আছে ওড়া, কেওড়া, বাইন, কাঁকড়া, খলসি, গড়ে, আমুড়, হিঙ্গল, গরান, গেঁয়ো, গর্জন, হেঁতাল, গোলপাতা, কেয়া, হুদো (ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ), নল, হোগলা, বেত, হরগোজা, নোনা ঝাউ, খড় জাতীয় কাশা, তুলাটেপারি, ছাঞ্চা, মোষেলতা (খুব শক্ত। এই লতা দিয়ে বুনো মোষ বেঁধে রাখলেও ছিঁড়তে পারত না), গিলেলতা, সাগর কলমি, সাগর নিসিন্দা, বোলা বা বোল্লা, সমুদ্দুর লাবণি ইত্যাদি। দক্ষিণাঞ্চলে ঘর ছাওয়ার কাজে গোলপাতার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
সুন্দরবনে ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।
বাঘের কথা বাদ দিয়ে সুন্দরবনের কথা বলা আর ডেনমার্কের যুবরাজকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট অভিনয়—সমান কথা। তবে বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের যুবরাজ নয়, সম্রাট। অবশ্য বাঘের সে দিন গিয়েছে। আগের মত দাপট তাদের আর নেই তো বটেই, খানিকটা চোরের মত পালিয়ে বেড়াতে হয়। সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র শ’ তিন-চারে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হিসাবে সাড়ে চারশ’ মত বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্য আড়াইশ’র বেশি নয়। এই বাঘ এত শক্তিশালী যে, বিরাট মোষ মেরে সেটাকে পিঠের ওপর ফেলে স্বচ্ছন্দে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। এদের মাথা প্রকাণ্ড, চোখ দুটি বড় বড়, উজ্জ্বল এবং দৃষ্টিও ভয়ানক। এদের রোষকষায়িত দৃষ্টির সামনে পড়লে ভয় পায় না এমন প্রাণী বিরল। এরা লম্বায় ১২ ফুট (লেজসহ), এবং ৪ ফুট (মাথার উচ্চতা ধরে) পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে।
সুন্দরবনের মত একটা বন নিয়ে মুদি দোকানের মত লাভ-লোকসানের হিসাব চলে না। আমাদের এ দেশের জন্য এই বনের যে গুরুত্ব তা নিক্তিতেও মাপার নয়। তবে একটা কথা অন্তত বলা দরকার, যে কোন বনই তার চতুর্দিকের বিশাল এলাকার বাতাস শীতল করে তোলে। সাগরের জলীয়বাষ্প মেঘ আকারে বনের ওপর দিকে এসে এই শীতল বায়ুর সংস্পর্শে আরো ঘনীভূত হয়ে বর্ষণ উপযোগী হয়। সুন্দরবন না থাকলে বেশিরভাগ মেঘই বিনা বর্ষণে চলে যেত হিমালয়ে। সেখানে বাধা পেয়ে ফেরার সময় অবশ্য বর্ষণ হত তবে সে বর্ষণের বেশিরভাগই হত হিমালয় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে। ফারাক্কা আছে, ‘তিস্তা’ আছে। আমাদের দেশের উজানে আরো নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যে বাধাগ্রস্ত হবে না—তার কোন গ্যারান্টি নেই। এর ওপর মেঘও যদি বিনা বর্ষণে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় তবে ‘সোনার বাংলা’ মরুময় হতে খুব বেশি সময় নেবে না।
এই পৃথিবীর প্রতিটি উদ্ভিদ, প্রতিটি প্রাণী একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এর একটা না থাকলে আরেকটা হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। জগতে কোন প্রাণীর বা কোন উদ্ভিদের কি দরকার—তার পুরোপুরি হদিস এখনো মানুষ পায়নি। তাই এই বন রক্ষার দায় শুধু আমাদের নয়, সারা বিশ্বের।
শেষ কথা
সুন্দরবনকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করা হয় ১৯৯৯ সালে। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও সর্ববৃহত্ এই ম্যানগ্রোভ বন শুধু আমাদের নয়, সারা বিশ্বের সম্পদ। এখানকার উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, মাছ সবকিছু রক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ যখন অতি জরুরি তখন এই বনের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক পরিবেশবাদী বলছেন, এই উদ্যোগ সুন্দরবনের জন্য বিপর্যয়কর। তবে কতৃপক্ষ সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছে।
এখন দীর্ঘ মেয়াদে যে সুন্দরবনের উপর প্রভাব ফেলবে তা আর বলা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের মনে রাখা দরকার যে একটা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা মংলা বন্দর না থাকলে তা আবার গড়ে তোলা সম্ভব হবে কিন্তু আমাদের সুন্দরবন হারিয়ে গেলে সে ক্ষতি কখনো পূরণ হবার নয়। গন্ডার, মোষ হারিয়ে গেছে সেই কবে আর এখন বাঘ, শুশুক, কুমির এবং বহু পাখি বিদায়ের পথে। উন্নয়ন আমাদের প্রয়োজন অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সেটা সুন্দরবনের বিনিময়ে নয়।
মূল লিখা লিখেছিলেন মলয়পাড়ে, কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকাতে, তা থেকেই এই নিয়ে এই আজকের লিখা।