বাগদা চিংড়ি চাষ আজ দক্ষিন এশিয়ার সীফুড ইন্ড্রাষ্ট্রির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ উপার্জনকারী খাত। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের চিংড়ি চাষীরা সেই সনাতন পদ্ধতিতেই চাষ করে যাচ্ছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদনে পিছিয়ে আছেন প্রতিবেশী চিংড়ি চাষী রাষ্ট্র গুলো থেকে। সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি একরে বছরে মাত্র ১৫০–১৮০ কেজি চিংড়ি পাওয়া যায়, সেখানে এমটিটি (Modified Traditional Technology) বা পরিবর্তিত সনাতন চাষ কৌশল (উন্নত সনাতন পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে) ব্যবহার করলে উৎপাদন বেড়ে দাড়াতে পারে প্রতি একরে ৪৫০–৬৫০ কেজি পর্যন্ত!
এমটিটি পদ্ধতি কী?
বস্তুত, এমটিটি হলো সনাতন চাষ পদ্ধতিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বৈজ্ঞানিক উপায় ও ঝুঁকিমুক্ত ভাবে চাষ করার কৌশল। সনাতন পদ্ধতিকেই ভালো চাষ ব্যবস্থাপনা (BMP) এবং বায়ো-সিকিউরিটির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো ভাইরাস প্রতিরোধ, পোনা বাঁচার হার বাড়ানো এবং অধিক ফলন নিশ্চিত করা।
কেন এমটিটি পদ্ধতি ভালো?
- ভাইরাসমুক্ত পোনা – এখানে শুধুমাত্র PCR পরীক্ষিত ভাইরাসমুক্ত বাগদা চিংড়ির পোনা ব্যবহার করা হয়।
- বায়ো-সিকিউরিটি ব্যবস্থা – পুকুরে বাহ্যিক জীবাণু প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
- পোনা বাঁচার হার বেশি – সঠিক নিয়ম অনুসরনে নার্সারীতে ৮০–৮৫% এবং চাষ পুকুরে ৯০–৯৫% পর্যন্ত পোনা বাঁচে।
- উচ্চ উৎপাদন – প্রতি একরে বছরে ৩–৪ বার পর্যন্ত চাষ করা যায়, তাই বাৎসরিক উৎপাদন হয় ৪৫০–৬৫০ কেজি।
- অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক – উৎপাদন খরচ কম এবং বাজারদর ভালো হলে একরে সহজেই ২ লক্ষ টাকার বেশি লাভ করা যায়।
কিভাবে চাষ করতে হবে?
এমটিটি চাষে সাধারণত দুটি পুকুর ব্যবহার করতে হয় –
- নার্সারী পুকুর (চাষ পুকুরের আয়তনের ১০–১৫%)
- চাষ পুকুর
নার্সারী পুকুর প্রস্তুত
- পাড় শক্ত ও উঁচু করতে হবে যাতে দূষিত পানি ও রোগজীবাণু প্রবেশ না করে।
- নেট দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে যেন কাঁকড়া, সাপ, ব্যাঙ বা অন্যান্য প্রাণী ঢুকতে না পারে।
- চুন, সার ও ব্লিচিং দিয়ে পুকুর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য চিটাগুড়, ইষ্ট, পালিশকুঁড়ো ব্যবহার করতে হবে।
- শেষে বিষাক্ততা পরীক্ষা করে রোগমুক্ত পোনা মজুদ করতে হবে।
চাষ পুকুর প্রস্তুত
- চুন, সার ব্যবহার করে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
- চাইলে ব্লিচিং প্রয়োগ করে জীবাণুমুক্ত করা যায় (১০ ppm হারে)।
- নার্সারী থেকে ২৫–৩৫ দিন বয়সী চিংড়ি পোনা প্রতিশতকে ৫০–৬০টি হারে মজুদ করতে হবে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- প্রতিদিন ৪০–৪৫% প্রোটিনযুক্ত গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য দিতে হবে। পোনা অবস্থায় ৪০-৫০% হলে ভাল হয়।
- নিয়মিত পানি পরীক্ষা, অক্সিজেন মাপা এবং সঠিক সময়ে খাবার প্রয়োগ করলে চিংড়ির বেঁচে থাকার হার অনেক বেড়ে যায়।
উৎপাদনের সম্ভাবনা
- নার্সারী পুকুরে ৬০০০টি পোনা মজুদ করলে ৪৮০০–৫০০০টি পোনা চাষ পুকুরে মজুদ করা সম্ভব।
- প্রায় ৯০–১১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি চিংড়ি ৩৩–৩৫ গ্রাম ওজন পায়।
- প্রতি একরে বছরে ৪৫০–৬৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হয়।
- সনাতন পদ্ধতির তুলনায় এমটিটি পদ্ধতিতে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি।
লাভের হিসাব
- ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি চিংড়ি উৎপাদনে খরচ হয়েছিল ৩৫০–৪৫০ টাকা, আর বিক্রি হয়েছিল ৮০০–৯৫০ টাকায়।
- বর্তমান বাজারদর হিসাবে একরে বছরে অন্তত ২ লক্ষ টাকা নীট মুনাফা করা সম্ভব বাগদা চিংড়ি থেকেই।
এই এমটিটি পদ্ধতি চাষে যেটি সব থেকে বেশী লক্ষনীয় তা হল এর সকল নিয়ম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা আর তা করতে পারলে, বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির উৎপাদনে এক নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে। যেখানে একরে বছরে ১৫০–১৮০ কেজি চিংড়ি পাওয়া যায়, সেই একই জায়গায় থেকে ৪৫০–৬৫০ কেজি পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব। আর উৎপাদন বেশি হলে যে মুনাফাও বেশি হবে, সেটা কে না জানে, বলুন।
